গৌরীপুর ভবন

কালিম্পং-এর গৌরীপুর ভবন বাঙালির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে, বিশেষ করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত হওয়ায়। এটি কেবল একটি ঐতিহাসিক বাড়িই নয়, এটি সংস্কৃতি ও স্মৃতির ধারক।

সংক্ষিপ্ত বিবরণ

কালিম্পং-এর ডুরপিন হিলের কাছে আপার কার্ট রোডে অবস্থিত গৌরীপুর ভবন একসময় বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর শৈলনিবাস ছিল। ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এই বাড়িটি পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এবং এর ব্যালকনি থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোরম দৃশ্য দেখা যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সম্পর্ক

গৌরীপুর ভবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে এর গভীর সংযোগ। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট চারবার এই বাড়িতে এসেছিলেন। মূলত অসুস্থতার কারণে তিনি পাহাড়ে বায়ু পরিবর্তনের জন্য আসতেন এবং এই বাড়িতেই থাকতেন।

 * জন্মদিন কবিতা আবৃত্তি: ১৯৪০ সালের ২৫শে বৈশাখ (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ৮০তম জন্মদিন এই বাড়িতেই পালন করেন। এই দিন তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘জন্মদিন’ কবিতাটি গৌরীপুর ভবন থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে আকাশবাণীতে সরাসরি আবৃত্তি করেছিলেন, যা ছিল কলকাতা ও কালিম্পং-এর মধ্যে টেলিফোন যোগাযোগের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাড়ির একটি ফলকে আজও এই স্মৃতিফলকটি দেখা যায়।

 * কবিতা রচনা: গৌরীপুর ভবনে থাকাকালীন তিনি ‘জন্মদিন’, ‘মায়া’, ‘উপহার’, ‘নামকরণ’ এবং ‘জলসংসার’ সহ আরও অনেক কবিতা রচনা করেছিলেন।

 * শেষ যাত্রা: ১৯৪০ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর তিনি শেষবারের মতো এই বাড়িতে এসেছিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে এই বাড়ি থেকেই কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়, এবং এর এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি প্রয়াত হন।

বর্তমান অবস্থা ও সংস্কার

একসময় গৌরীপুর ভবন জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের অভাব স্পষ্ট ছিল। ২০১১ সালের ভূমিকম্পে এর দেওয়ালে বড় ফাটল ধরেছিল। তবে, ২০১৯ সাল থেকে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন বাড়িটির সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। পরিকল্পনা করা হয়েছে, সংস্কারের পর বাড়িটিকে একটি রবীন্দ্র জাদুঘর এবং গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে, যেখানে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং তাঁর সৃষ্টিগুলো সংরক্ষণ ও প্রদর্শিত হবে। এটি পর্যটকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি কালিম্পং ভ্রমণে আসা রবীন্দ্রানুরাগী এবং ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে একটি অবশ্য দর্শনীয় স্থান। এটি কালিম্পং শহর থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে ডুরপিন দারা যাওয়ার পথে অবস্থিত। গৌরীপুর ভবন কেবল একটি ইমারত নয়, এটি বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি জীবন্ত দলিল, যা রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিকে আজও সযত্নে লালন করে।

কিভাবে এখানে আসবেন

 * গাড়িতে: আপনি কালিম্পং শহর থেকে ট্যাক্সি বা স্থানীয় কোনো গাড়ি ভাড়া করে গৌরীপুর ভবনে যেতে পারেন। এটি ডুরপিন দারা যাওয়ার পথেই পড়ে।

 * হাঁটা: যদি আপনি কালিম্পং শহরের কেন্দ্রে থাকেন এবং হাঁটতে পছন্দ করেন, তাহলে হেঁটেও গৌরীপুর ভবনে পৌঁছানো সম্ভব। তবে, এটি কিছুটা চড়াই পথ হতে পারে।

Google Maps

Scroll to Top