মামা ভাগ্নে পাহাড়

বীরভূমের মামা ভাগ্নে পাহাড় পশ্চিমবঙ্গের একটি উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক বিস্ময় এবং জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এটি দুবরাজপুর শহরের কাছে অবস্থিত এবং বীরভূম জেলার একমাত্র পাহাড়।
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য
মামা ভাগ্নে পাহাড় ছোটনাগপুর মালভূমির পূর্ব প্রান্তের একটি অংশ। এটি মূলত গ্রানাইট শিলা দ্বারা গঠিত। এই পাহাড়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো দুটি বিশাল গোলাকার পাথর, যার একটি অন্যটির ওপর ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে। এই ব্যতিক্রমী শিলা গঠনই “মামা ভাগ্নে” নামের উৎস, কারণ এটি মামা ও ভাগ্নের অন্তরঙ্গ সম্পর্ককে প্রতীকীভাবে তুলে ধরে। চারপাশে সবুজ কৃষি জমির মাঝে এই পাথরের উপস্থিতি এটিকে আরও রহস্যময় করে তোলে। এই অঞ্চলে আরও অনেক গোলাকার ধূসর গ্রানাইট, গোলাপী কোয়ার্টজ, ধূসর ফেল্ডস্পার এবং কালো অভ্র দেখা যায়।
ভূতাত্ত্বিকদের মতে, বহু বছর আগে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ছোটনাগপুর মালভূমির সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেই প্রক্রিয়ায় এই পাথরগুলি ভূপৃষ্ঠে উঠে আসে।
কিংবদন্তি ও পুরাণকথা
মামা ভাগ্নে পাহাড়কে ঘিরে বেশ কিছু আকর্ষণীয় কিংবদন্তি প্রচলিত আছে:
* রামায়ণের গল্প: একটি জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুসারে, ত্রেতাযুগে ভগবান রাম যখন লঙ্কা যাওয়ার জন্য সেতু নির্মাণ করছিলেন, তখন হিমালয় থেকে পাথর নিয়ে যাচ্ছিলেন তার রথে করে। দুবরাজপুরের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ রথের ঘোড়া ভীত হয়ে পড়ে এবং রথ থেকে কিছু পাথর নিচে পড়ে যায়। সেই পাথরগুলিই আজকের মামা ভাগ্নে পাহাড়।
* বিশ্বকর্মার কাহিনি: অন্য একটি গল্প অনুযায়ী, দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা মহাদেব শিবের আদেশে এক রাতের মধ্যে দ্বিতীয় কাশী (বারাণসী) নির্মাণ করছিলেন। কিন্তু কাজ শুরু করার আগেই ভোর হয়ে যায় এবং তিনি কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে যান। বিশ্বকর্মা যে পাথরগুলি সংগ্রহ করেছিলেন, সেগুলিই মামা ভাগ্নে পাহাড় রূপে রয়ে গেছে।


পর্যটন এবং সংস্কৃতি
মামা ভাগ্নে পাহাড় বর্তমানে একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। শান্তিনিকেতন থেকে এটি প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পাহাড়ের নিচে পাহাড়েশ্বর শিব মন্দির অবস্থিত, যা পর্যটকদের কাছে একটি দর্শনীয় স্থান। পাহাড়েশ্বর শ্মশানকালী মন্দির এবং নিকটবর্তী হেতমপুর রাজবাড়ি এই অঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে।
মামা ভাগ্নে পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং রহস্যময় পরিবেশ অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতাকেও আকর্ষণ করেছে। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘অভিযান’ (১৯৬২)-এ এই পাহাড়ের একটি পাথরের ওপর আরেকটি পাথরের ভারসাম্যকে মানব সভ্যতার চিরন্তন পাপের বোঝার প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছিল। এছাড়াও, সন্দীপ রায়ের ‘রবার্টসনের রুবি’ এবং ‘গোঁসাইপুর সরগরম’-এর মতো চলচ্চিত্রের শুটিং এই অঞ্চলে হয়েছে।
Google Maps
কিভাবে এখানে আসবেন
কলকাতা থেকে রেল বা সড়কপথে সহজেই দুবরাজপুর পৌঁছানো যায়। নিকটতম রেলস্টেশন হলো দুবরাজপুর, যা পাহাড় থেকে খুব কাছে। এছাড়া, বোলপুর (শান্তিনিকেতন) থেকেও মামা ভাগ্নে পাহাড়ে যাওয়া সহজ।
মামা ভাগ্নে পাহাড় বীরভূমের একটি অনন্য প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থান, যা স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত।