মদন মোহন মন্দির

বিষ্ণুপুরের মদন মোহন মন্দির হলো মল্লভূম রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি। ১৬৯৪ সালে (১০০০ মল্লাব্দ) মল্লরাজ দুর্জন সিংহ দেব এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এটি কৃষ্ণকে উৎসর্গ করা একটি একরত্ন মন্দির, যা বর্তমানে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ (Archaeological Survey of India) দ্বারা সংরক্ষিত।

মন্দিরটির বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো:

স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী

 * গঠন: মন্দিরটি একটি উঁচু বর্গাকার প্ল্যাটফর্মের (প্রায় ১২.২ মিটার × ১২.২ মিটার) উপর নির্মিত। এর উচ্চতা প্রায় ১০.৭ মিটার। এটি বাংলার নিজস্ব একরত্ন শৈলীতে তৈরি, যার অর্থ একটি বক্রাকার ছাদ এবং তার মাঝখানে একটি মাত্র চূড়া বা রত্ন রয়েছে।

 * উপাদান: সম্পূর্ণ মন্দিরটি পোড়ামাটির ইট দিয়ে তৈরি। এটি বিষ্ণুপুরের প্রসিদ্ধ টেরাকোটা শিল্পের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

 * অলঙ্করণ: মন্দিরের প্রধান আকর্ষণ হলো এর দেওয়াল জুড়ে বিস্তৃত পোড়ামাটির ফলকের অসাধারণ কারুকার্য। যদিও মন্দিরের সামনের দিকের দেওয়ালে এই অলংকরণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তবে অন্যান্য দিকেও কিছু কিছু কাজ রয়েছে। এই ফলকগুলিতে প্রধানত হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, বিশেষত রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী এবং কৃষ্ণলীলার দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়াও, বিভিন্ন ধরনের ফুল, লতাপাতা, হংসলতা এবং সেই সময়ের সামাজিক জীবনের চিত্রও দেখতে পাওয়া যায়।

ইতিহাস ও কিংবদন্তী

 * প্রতিষ্ঠা: মল্লরাজ দুর্জন সিংহ দেব ১৬৯৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। কিংবদন্তী অনুসারে, এই মন্দিরটি মল্ল রাজবংশের কুলদেবতা মদনমোহনকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।

 * বর্গী আক্রমণ: একটি লোকগাথা অনুসারে, মারাঠা বর্গীদের আক্রমণের সময় যখন মল্লরাজা গোপাল সিংহদেব প্রায় পরাজিত হতে চলেছিলেন, তখন স্বয়ং মদনমোহন বিগ্রহ মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে কামান দেগে বর্গীদের প্রতিহত করেন।

বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত ‘দলমাদল’ কামানটির সঙ্গে এই কাহিনীর যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়।

 * বিগ্রহ: মন্দিরের মূল বিগ্রহটি হলো মদনমোহন, যিনি রাধা-কৃষ্ণের একটি রূপ। কথিত আছে, মল্লরাজা চৈতন্য সিংহের সময় মদনমোহনের বিগ্রহটি বাগবাজারের বিখ্যাত ধনী গোকুল চন্দ্র মিত্রের কাছে বন্ধক রাখা হয়েছিল। যদিও সেই বিগ্রহ আর বিষ্ণুপুরে ফিরে আসেনি, তবে এই মন্দিরে এখনো নিত্য পূজা-অর্চনা হয়ে থাকে।

মদন মোহন মন্দির তার শিল্প, স্থাপত্য এবং ঐতিহ্যের কারণে শুধু পর্যটকদের কাছে নয়, ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছেও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান।

Google Maps

কিভাবে এখানে আসবেন

সড়কপথে

 * গাড়িতে: কলকাতা থেকে গাড়িতে করে বিষ্ণুপুর যেতে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে, যা সাধারণত ৪ থেকে ৪.৫ ঘন্টা সময় নেয়। প্রধানত SH 2 সড়ক পথ ব্যবহার করা হয়।

 * বাসে: কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুরের উদ্দেশ্যে নিয়মিত সরকারি ও বেসরকারি বাস চলাচল করে। এসপ্ল্যানেড, বাবুঘাট বা করুণাময়ী বাস স্ট্যান্ড থেকে এই বাসগুলো পাওয়া যায়।

রেলপথে

হাওড়া বা সাঁতরাগাছি থেকে বিষ্ণুপুর (VSU) রেল স্টেশনের জন্য বেশ কিছু ট্রেন আছে। কিছু জনপ্রিয় ট্রেন হলো:

 * রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস (12883)

 * আরণ্যক এক্সপ্রেস (12885)

 * ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস (18627)

যাতায়াতের সঠিক সময়সূচী এবং ভাড়া জানার জন্য আপনি রেলের ওয়েবসাইট অথবা টিকিট বুকিং অ্যাপ দেখতে পারেন।

Scroll to Top