কিরীটেশ্বরী মন্দির (সতীপীঠ)

মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যতম প্রাচীন এবং পবিত্র স্থান হলো কিরীটেশ্বরী মন্দির। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে ৫১টি সতীপীঠের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত। এখানে দেবী সতীর ‘কিরীট’ বা মুকুটের কণা পতিত হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। সম্প্রতি, এই কিরীটেশ্বরী গ্রামটি ভারতের সেরা পর্যটন গ্রামের তকমা পেয়েছে।
কিরীটেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস ও তাৎপর্য
* পৌরাণিক গুরুত্ব: হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দক্ষযজ্ঞের পর মহাদেব যখন সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করেন, তখন ভগবান বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করেন। সতীর দেহের বিভিন্ন অংশ যেখানে পতিত হয়েছিল, সেই স্থানগুলো শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বাস করা হয়, মুর্শিদাবাদের এই স্থানে সতীর মাথার ‘কিরীট’ বা মুকুট পড়েছিল, যার থেকে এই স্থানের নাম ‘কিরীটেশ্বরী’।
* ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: মূল মন্দিরটি ১৪০৫ সালে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরে ১৯ শতকে লালগোলার রাজা দর্পনারায়ণ রায় বর্তমান মন্দিরটি পুনঃনির্মাণ করেন। মন্দিরের স্থাপত্যে হিন্দু, মুসলিম এবং বৌদ্ধ ধর্মের ছাপ দেখা যায়, যা এই স্থানের সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির এক চমৎকার উদাহরণ। কিংবদন্তি আছে, মীর জাফর যখন কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হন, তখন তিনি এই মন্দিরের দেবীর চরণামৃত পান করে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
মন্দির দর্শন ও ভ্রমণ পরিকল্পনা
* দর্শনীয় স্থান: মন্দিরে দুটি প্রধান কাঠামো দেখা যায় – একটি নতুন মন্দির এবং আরেকটি পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আজও সেই প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। এর পাশেই রয়েছে একটি গুপ্ত মন্দির, যেখানে দেবীর পূজা করা হয়। এখানে রাজা রাজবল্লভের প্রতিষ্ঠিত একটি শিব মন্দিরও দেখতে পাবেন।
* পূজা ও উৎসব: এই মন্দিরে দেবী কিরীটেশ্বরী দক্ষিণাকালী রূপে পূজিত হন। পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবার এখানে একটি বিশেষ মেলা বসে। এছাড়া দুর্গাপূজা ও কালীপূজার সময় প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়।
* অন্যান্য দর্শনীয় স্থান: কিরীটেশ্বরী মন্দিরের কাছাকাছি আরও অনেক ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যেমন: হাজারদুয়ারী প্রাসাদ, মতিঝিল পার্ক, খোসবাগ, কাঠগোলা বাগান, ইত্যাদি। মুর্শিদাবাদে একদিন বা দুদিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা করে এই স্থানগুলো ঘুরে দেখা যেতে পারে।


গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
* কিরীটেশ্বরী মন্দিরে দেবীর কোনো মূর্তি বা ছবি পূজিত হয় না, বরং একটি প্রস্তর খণ্ডকে দেবী রূপে পূজা করা হয়।
* পর্যটকদের জন্য থাকার ভালো ব্যবস্থা না থাকায়, মুর্শিদাবাদ বা বহরমপুরে হোটেল বা লজ ভাড়া করে থাকতে পারেন এবং সেখান থেকে দিনের বেলা মন্দিরে ঘুরে আসতে পারেন।
* এখানে স্থানীয় কিছু দোকানে খাবার ও পানীয় পাওয়া যায়।
* মন্দিরে প্রবেশ করার আগে স্থানীয় রীতিনীতি ও পবিত্রতা বজায় রাখা উচিত।
কিরীটেশ্বরী মন্দির শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি ইতিহাস, স্থাপত্য এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এখানে গেলে আপনি ইতিহাস, ধর্ম এবং প্রকৃতির এক সুন্দর মেলবন্ধন দেখতে পাবেন।
কিভাবে এখানে আসবেন
কিরীটেশ্বরী মন্দির পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত। এখানে পৌঁছানোর জন্য বেশ কয়েকটি পথ রয়েছে:
* ট্রেনে: কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ বা লালবাগ কোর্ট রোড স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনে যেতে পারেন। স্টেশন থেকে টোটো বা অটো ভাড়া করে সহজেই কিরীটেশ্বরী মন্দিরে পৌঁছানো যায়।
* বাসে: কলকাতা থেকে বাসযোগে বহরমপুর বা মুর্শিদাবাদ এসে, সেখান থেকে টোটো বা অন্যান্য স্থানীয় যানবাহনের সাহায্যে মন্দির যাওয়া যায়।
* সড়কপথে: নিজস্ব গাড়ি নিয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে মুর্শিদাবাদে পৌঁছাতে পারেন।