জগৎ শেঠের বাড়ি
মুর্শিদাবাদে জগৎ শেঠের বাড়ি: একটি বিস্তারিত ভ্রমণ গাইড
মুর্শিদাবাদে ভ্রমণ মানেই ইতিহাসের গভীরে ডুব দেওয়া, আর সেই ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো জগৎ শেঠের বাড়ি। এই বাড়িটি কেবল একটি স্থাপত্য নয়, এটি বাংলার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নীরব সাক্ষী। পলাশীর যুদ্ধের সময় বাংলার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা কীভাবে কয়েকটি পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল, তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো এই বাড়িটি।
জগৎ শেঠ কারা ছিলেন?
জগৎ শেঠ কোনো একজনের নাম নয়, এটি ছিল একটি উপাধি যা তৎকালীন ভারতবর্ষের সবচেয়ে ধনী ব্যাঙ্কার এবং মহাজন পরিবারকে দেওয়া হয়েছিল। এই পরিবারের মূল নাম ছিল ফতেহ চাঁদ। মোঘল সম্রাট ফররুখসিয়র তাকে ‘জগৎ শেঠ’ বা ‘বিশ্বের ব্যাঙ্কার’ উপাধি দেন। তাদের অর্থবিত্ত এতটাই ছিল যে তারা নবাবদেরও ঋণ দিত এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও তাদের উপর নির্ভরশীল ছিল। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পতনে এই পরিবারের নীরব সমর্থন ছিল বলে মনে করা হয়।


কোথায় অবস্থিত ?
জগৎ শেঠের বাড়িটি মুর্শিদাবাদ শহরের লালবাগ এলাকার মহিমাপুর গ্রামে ভাগীরথী নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত।
বাড়িটির বর্তমান অবস্থা এবং কী দেখবেন?
বর্তমানে জগৎ শেঠের বাড়িটি একটি সংগ্রহশালা হিসেবে পরিচিত। এটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত। যদিও বাড়িটির অনেক অংশই সময়ের সাথে ধ্বংস হয়ে গেছে, তবুও এর কিছু অংশ আজও অক্ষত আছে।
* মূল ভবন: বাড়িটির যে অংশটি এখনও টিকে আছে, সেখানে তাদের পারিবারিক মন্দির, গোপন সুড়ঙ্গপথ এবং কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। বলা হয়, এই গোপন সুড়ঙ্গটি বাড়ির মহিলাদের যাতায়াতের জন্য এবং জরুরি পরিস্থিতিতে পালানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
* কাছারি ঘর ও জৈন মন্দির: বাড়ির ভেতরে ছিল তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য কাছারি ঘর। কাছেই রয়েছে তাদের নির্মিত একটি জৈন মন্দির, যা এই পরিবারের ধর্মীয় বিশ্বাসকে তুলে ধরে। যদিও মন্দিরটি পুরোনো, এর স্থাপত্যশৈলী আজও মুগ্ধ করার মতো।
* সংগ্রহশালা: বাড়ির ভেতরে একটি ছোট সংগ্রহশালা রয়েছে যেখানে সেই সময়ের কিছু মুদ্রা, অস্ত্রশস্ত্র এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখা আছে। এই জিনিসগুলো দেখে সেই সময়ের জীবনযাত্রা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
ভ্রমণের সেরা সময়
মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের সেরা সময় হলো শীতকাল। অর্থাৎ, অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। এই সময় আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং ঘুরে বেড়ানোর জন্য আদর্শ। গরমকালে (মার্চ থেকে জুন) তাপমাত্রা খুব বেশি থাকে, তাই ভ্রমণ কষ্টসাধ্য হতে পারে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
* জগৎ শেঠের বাড়ির সংগ্রহশালায় প্রবেশ করতে সামান্য টিকিট লাগে।
* বাড়িটি ঘুরে দেখতে মোটামুটি ৩০-৪৫ মিনিট সময় লাগে।
* পুরো মুর্শিদাবাদ ঘুরে দেখার জন্য একদিনে শুধু জগৎ শেঠের বাড়ি না দেখে আশেপাশে আরো অনেক ঐতিহাসিক স্থান যেমন হাজার দুয়ারী প্রাসাদ, কাঠগোলা বাগান, মতিঝিল ইত্যাদিও দেখতে পারেন।
* স্থানীয় গাইড নিলে প্রতিটি স্থানের ইতিহাস সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন।
জগৎ শেঠের বাড়ি ভ্রমণ আপনাকে শুধু একটি পুরোনো বাড়ি দেখাবে না, বরং আপনাকে বাংলা এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। এই বাড়িটি নীরব সাক্ষী হয়ে আছে সেই সময়ের, যখন এক ব্যবসায়ী পরিবারই নির্ধারণ করত নবাবদের ভাগ্য।

কিভাবে এখানে আসবেন
* রেলপথে: সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ট্রেনে করে মুর্শিদাবাদ রেলওয়ে স্টেশন বা আজিমগঞ্জ জংশনে পৌঁছানো। কলকাতা থেকে এই স্টেশনগুলোতে নিয়মিত ট্রেন চলাচল করে। স্টেশন থেকে অটো বা টোটো ভাড়া করে সহজেই জগৎ শেঠের বাড়িতে যাওয়া যায়।
* সড়কপথে: কলকাতা থেকে গাড়িতে গেলে NH12 ধরে মুর্শিদাবাদ পৌঁছাতে প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা সময় লাগে। মুর্শিদাবাদ শহর থেকে অটো বা টোটো নিয়ে এই বাড়িটি দেখতে যাওয়া যায়।