জল্পেশ শিব মন্দির

জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ির কাছে অবস্থিত জল্পেশ শিব মন্দির উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ শৈবতীর্থ। এটি জরদা নদীর তীরে অবস্থিত এবং ভ্রামরী শক্তিপীঠের ভৈরব জল্পেশ-এর মন্দির হিসেবে পরিচিত। এই মন্দিরটি শুধু একটি উপাসনালয় নয়, এটি এই অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠা
জল্পেশ মন্দিরের ইতিহাস বেশ প্রাচীন ও একাধিক বার পুনর্নির্মাণের সাথে জড়িত।
* প্রতিষ্ঠা: ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহারের মহারাজা বিশ্ব সিংহ এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন মহারাজা নরনারায়ণের পিতা।
* পুনর্নির্মাণ:
* ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে নরনারায়ণ মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন।
* এর প্রায় এক শতাব্দী পর, ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহারের মহারাজা প্রাণনারায়ণ এটি আবার পুনর্নির্মাণ করেন।
* ১৮৯৯ সালের ৩০শে জানুয়ারি রাজা জগেন্দ্র দেব রায়কতের স্ত্রী রানী জগদেশ্বরী দেবী মন্দিরটির পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন।

* অন্যান্য মত: কিছু কিংবদন্তি অনুসারে, এটি প্রায় হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন মন্দির। বখতিয়ার খিলজির কামরূপ আক্রমণের সময় মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে ভুটানের রাজা এটি আবার তৈরি করান। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, কোচবিহারের রাজারা সপ্তদশ শতাব্দীতেই এর নির্মাণ করেন।
* তত্ত্বাবধান: একসময় কোচবিহারের রাজাদের সঙ্গে জলপাইগুড়ির রায়কত রাজাদের মন্দিরের কর্তৃত্ব নিয়ে বিবাদ ছিল। পরবর্তীকালে বৈকুণ্ঠপুরের রায়কতরাই মন্দিরের তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
স্থাপত্য শৈলী
জল্পেশ মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী বেশ আকর্ষণীয় এবং কিছু অংশে ইসলামিক স্থাপত্যের ছোঁয়াও দেখা যায় বলে অনেকে মনে করেন।
* মন্দিরটি প্রায় এক একর জমির উপর নির্মিত, উচ্চতা প্রায় ১২৭ ফুট, দৈর্ঘ্য ১২৪ ফুট এবং প্রস্থ ১২০ ফুট।
* মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি জল লিঙ্গ বা অনাদি নামক শিবলিঙ্গ রয়েছে, যা একটি গর্তের মধ্যে অবস্থিত এবং এর খুব অল্প অংশই দেখা যায়। এই শিবলিঙ্গ মসৃণ নয়, বরং খাঁজযুক্ত। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এটি একটি উল্কাপিণ্ড।
উৎসব ও মেলা
জল্পেশ মন্দিরে সারা বছরই ভক্তদের আনাগোনা থাকে, তবে কিছু বিশেষ উৎসব ও মেলাতে বিপুল জনসমাগম হয়:
* মহা শিবরাত্রি: এটি মন্দিরের প্রধান উৎসব। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের শিব চতুর্দশীতে এখানে বিশেষ পূজা হয় এবং মন্দির চত্বরে বিশাল মেলা বসে। এটি উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম মেলাগুলির মধ্যে অন্যতম, যেখানে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে ভক্তরা আসেন।
* শ্রাবণী মেলা: শ্রাবণ মাসে এখানে শ্রাবণী মেলা বসে। এই সময় দূর-দূরান্ত থেকে তীর্থযাত্রীরা জল নিয়ে এসে শিবের মাথায় জল ঢালতে ভিড় করেন।

কিভাবে এখানে আসবেন
* সড়কপথে:
* ময়নাগুড়ি শহর থেকে জল্পেশ মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ৬-৮ কিমি। ময়নাগুড়ি বাইপাস ক্রসিং থেকে এটি মাত্র ৬ কিমি দূরে।
* জলপাইগুড়ি শহর থেকে প্রায় ২৩-২৫ কিমি দূরে অবস্থিত।
* ময়নাগুড়ি বা জলপাইগুড়ি থেকে ট্যাক্সি বা ভ্যান রিক্সা ভাড়া করে মন্দিরে পৌঁছানো যায়।
* রেলপথে: নিকটতম রেল স্টেশন হলো জলপাইগুড়ি রোড (প্রায় ২৫ কিমি) এবং জলপাইগুড়ি টাউন (প্রায় ২৩ কিমি)। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি বা বাস পাওয়া যায়।
* আকাশপথে: নিকটতম বিমানবন্দর হলো বাগডোগরা বিমানবন্দর (প্রায় ৭৫ কিমি)। বিমানবন্দর থেকে গাড়ি ভাড়া করে মন্দিরে পৌঁছানো যায়।