কালিম্পং জেলার পর্যটন কেন্দ্র গুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ
কালিম্পং, পশ্চিমবঙ্গের একটি নবীন জেলা, তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শান্ত পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। ২০১৭ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি এটি দার্জিলিং জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ২১তম জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দার্জিলিং হিমালয়ের অংশ হিসেবে, কালিম্পং তার মনোরম জলবায়ু এবং সহজগম্যতার কারণে একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
কালিম্পং জেলার ইতিহাস
কালিম্পং অঞ্চলের ইতিহাস সিকিম ও ভুটান রাজ্যের দ্বারা পর্যায়ক্রমে শাসিত হওয়ার গল্প বলে। ১৭০৬ সালে ভুটান রাজা সিকিমের কাছ থেকে এই অঞ্চলটি জয় করেন এবং এর নামকরণ করেন কালিম্পং। ১৮৬৪ সালের অ্যাংলো-ভুটান যুদ্ধের পর সিনচুলা চুক্তির মাধ্যমে এই অঞ্চল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে আসে। ১৮৬৬ সালে এটি দার্জিলিং জেলার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পরে এটি ‘পশ্চিম ডুয়ার্স’ জেলার মহকুমা হয়। ভারতের স্বাধীনতার পর কালিম্পং পশ্চিমবঙ্গের অংশ হয়ে ওঠে। কালিম্পং দীর্ঘকাল ধরে ভারত-তিব্বত বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।
কালিম্পং জেলার সংস্কৃতি ও ভাষা
কালিম্পং জেলার সংস্কৃতিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রার প্রভাব দেখা যায়। এখানকার প্রধান অধিবাসী হলো লেপচা সম্প্রদায়, এছাড়াও ভুটিয়া, লিম্বু এবং তিব্বতি জনগোষ্ঠীর মানুষ এখানে বসবাস করেন। ১৯৫৯ সালে চীনের তিব্বত আক্রমণের পর বহু তিব্বতি এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন, যার ফলে এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক প্রচলন ঘটে।
কালিম্পং জেলার সরকারি ভাষা বাংলা ও নেপালি। এছাড়াও লেপচা, লিম্বু এবং তিব্বতি ভাষা এখানকার জনজাতিদের মধ্যে প্রচলিত। লেপচা এবং লিম্বু উভয় ভাষারই নিজস্ব লিপি রয়েছে। লেপচা মিউজিয়াম এই অঞ্চলের লেপচা জনজাতির উপাসনা পদ্ধতি, বাদ্যযন্ত্র, পাণ্ডুলিপি এবং হাতে বোনা জিনিসপত্র সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কালিম্পং জেলার পর্যটন কেন্দ্র
কালিম্পং-এ ঘোরার জন্য বেশ কিছু সুন্দর এবং শান্ত জায়গা রয়েছে:
* ডেলো হিল (Deolo Hill): এটি কালিম্পং শহরের সর্বোচ্চ স্থান, যেখান থেকে চারপাশের পাহাড়ি দৃশ্য এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার এক মনোরম প্যানোরামিক দৃশ্য দেখা যায়। এখানে প্যারাগ্লাইডিং-এর ব্যবস্থাও আছে।
* দুরপিন মঠ (Durpin Monastery/Zang Dhok Palri Phodang Monastery): কালিম্পং-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ মঠ। এখান থেকেও চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করা যায় এবং মঠের ভেতরে সুন্দর ফ্রেস্কো ও ধর্মীয় শিল্পকর্ম রয়েছে। এটি ১৯৭৬ সালে দালাই লামার দ্বারা উৎসর্গীকৃত হয়েছিল।
* পাইন ভিউ নার্সারি (Pine View Nursery): এটি এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম ক্যাকটাস নার্সারি, যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস ও সুকুলেন্ট গাছ দেখা যায়।
* মর্গান হাউস (Morgan House): একটি ঐতিহাসিক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাংলো, যা বর্তমানে পর্যটন লজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
* রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত গৌরীপুর ভবন/মংপু: দার্জিলিং যাওয়ার পথে মংপুতে অবস্থিত এই স্থানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত।
* অফবিট গ্রাম: কালিম্পং জেলার চারপাশে আরও বেশ কিছু শান্ত ও সুন্দর গ্রাম রয়েছে, যেমন – চারখোল, পেডং, কোলাখাম, লোলেগাঁও, রিশপ, ইচ্ছেগাঁও, তোদে-তাংতা এবং ইয়েলবং। এই গ্রামগুলো প্রকৃতির শান্ত পরিবেশে সময় কাটানোর জন্য আদর্শ।
* নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক: এটি জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সর্বাধিক সমৃদ্ধ ন্যাশনাল পার্ক।
কালিম্পং ঘোরার সেরা সময়
কালিম্পং ভ্রমণের জন্য মার্চ থেকে মে মাস এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাস সবচেয়ে ভালো সময়। এই সময় আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং আকাশ পরিষ্কার থাকায় কাঞ্চনজঙ্ঘার স্পষ্ট দৃশ্য দেখা যায়। বর্ষাকালে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) ভূমিধসের সম্ভাবনা থাকায় এই সময়ে ভ্রমণ এড়িয়ে চলাই ভালো।
কালিম্পং তার শান্ত পরিবেশ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য পর্যটকদের কাছে একটি দারুণ গন্তব্য। আপনি যদি পাহাড়, প্রকৃতি এবং নির্জনতার মধ্যে কিছু সময় কাটাতে চান, তাহলে কালিম্পং আপনার জন্য উপযুক্ত স্থান।