তারা মায়ের মন্দির

তারা মায়ের মন্দির, যা তারাপীঠ মন্দির নামেও পরিচিত, পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাট শহরের কাছে অবস্থিত একটি বিখ্যাত হিন্দু তীর্থস্থান। এটি তান্ত্রিক দেবী তারার মন্দির এবং মন্দির-সংলগ্ন শ্মশানক্ষেত্রের জন্য প্রসিদ্ধ।
অবস্থান ও তাৎপর্য
তারাপীঠ একটি সিদ্ধপীঠ, অর্থাৎ বিশ্বাস করা হয় যে এখানে সাধনা করলে সাধক জ্ঞান, আনন্দ ও অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করতে পারেন। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মন্দির ও শ্মশান একটি অত্যন্ত পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। এটি একান্ন সতীপীঠের অন্যতম বলেও কথিত আছে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এখানে সতীর তৃতীয় নয়ন বা নয়নতারা পতিত হয়েছিল এবং প্রস্তরীভূত হয়ে যায়। এই স্থানটি তন্ত্রসাধনার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
দেবীর স্বরূপ ও পূজা
মন্দিরের প্রধান দেবী হলেন উগ্রতারা, যা দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় বিদ্যা। তারামন্দিরে দেবী উগ্রতাঁরার শিলারূপ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। মূল প্রস্তরমূর্তিটি একটি তিন ফুট উঁচু ধাতব মূর্তির মধ্যে রাখা থাকে, যা দর্শনার্থীরা সাধারণত দেখতে পান। এই ধাতব মূর্তিটি দেবী তারার ভীষণা,
চতুর্ভূজা, মুণ্ডমালাধারিণী এবং লোলজিহ্বা মূর্তি।
তারাপীঠ এখানকার “পাগলা সন্ন্যাসী” বামাক্ষ্যাপার জন্যও প্রসিদ্ধ। বামাক্ষ্যাপা এই মন্দিরে পূজা করতেন এবং মন্দির-সংলগ্ন শ্মশানক্ষেত্রে তন্ত্রসাধনা করতেন। তিনি তারা দেবীর পূজাতেই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
মন্দিরের স্থাপত্য
মন্দিরটি উত্তরমুখী আটচালা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এবং লাল ইঁটের তৈরি। এর ভিতের দেওয়াল বেশ মোটা এবং উপরিভাগে শিখর পর্যন্ত একাধিক ধনুকাকৃতি খিলান রয়েছে। চারচালার ওপরে চার কোণে চারটি ছোট ছোট চূড়া আছে। মন্দিরের চূড়ায় একটি তামার পত্তাকাসহ ত্রিশূল তিনটি পদ্ম ভেদ করে উঠেছে। মন্দিরের প্রবেশপথের মধ্য খিলানের ওপর দুর্গার প্রতিকৃতি দেখা যায়। মন্দিরের বিভিন্ন স্থানে মহাভারত ও কৃষ্ণলীলার চিত্র খোদিত আছে। এখানকার “জীবিত কুণ্ড” একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অলৌকিক স্থান হিসেবে পরিচিত। এটি তারাপীঠ মন্দিরের পাশেই অবস্থিত একটি পুকুর বা কুণ্ড।


পূজার নিয়মাবলী
তারাপীঠ মন্দিরে পূজার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে:
* মন্দির ভোরে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে যায় এবং দুপুরে ভোগের জন্য প্রায় এক ঘণ্টা বন্ধ থাকে।
* মোবাইল ফোন নিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
* ভক্তরা মায়ের চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করতে পারেন, তবে পুজোর উপাচার সেবাইতরাই মায়ের পায়ে ছোঁয়ান।
* গর্ভগৃহ ও বারান্দায় নারকেল ফাটানো, দেবী বিগ্রহে আলতা, অগরু দেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
* সাধারণ ও বিশেষ লাইনে পর্যায়ক্রমে ভক্তদের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়। বিশেষ লাইনে পুজোর জন্য মন্দির কমিটির অফিস থেকে কুপন সংগ্রহ করতে হয়।
তারাপীঠ শুধুমাত্র একটি মন্দির নয়, এটি সাধনা ও আধ্যাত্মিকতার একটি কেন্দ্র, যেখানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও তীর্থযাত্রীর সমাগম হয়।
Google Maps
কিভাবে এখানে আসবেন
রেলপথে:
* তারাপীঠের নিকটতম রেলওয়ে স্টেশন হল তারাপীঠ রোড (TPF)। এটি রামপুরহাট জংশন থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
* রামপুরহাট জংশন (RPH) একটি বড় স্টেশন এবং এটি ভারতের বিভিন্ন প্রধান শহর যেমন কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর এবং গুয়াহাটির সাথে সংযুক্ত।
* রামপুরহাট থেকে তারাপীঠ রোড স্টেশনে লোকাল ট্রেন পাওয়া যায়, অথবা অটো রিকশা বা টোটো করে সরাসরি তারাপীঠ মন্দিরে যাওয়া যায়।
সড়কপথে:
* তারাপীঠ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহর এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির সাথে সড়কপথে ভালোভাবে সংযুক্ত।
* কলকাতা থেকে তারাপীঠের দূরত্ব প্রায় ২২০ কিলোমিটার। বাস বা ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যায়।
* রামপুরহাট থেকে তারাপীঠের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। এখানে নিয়মিত বাস, অটো রিকশা এবং টোটো চলাচল করে।
আকাশপথে:
* তারাপীঠের নিকটতম বিমানবন্দর হল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (CCU), কলকাতা।
* বিমানবন্দর থেকে ট্যাক্সি বা বাসে করে রামপুরহাট যাওয়া যায়, এবং সেখান থেকে তারাপীঠ।
আপনার যাত্রা শুরু করার আগে ট্রেনের সময়সূচী বা বাসের রুট সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া ভালো।