মালদা জেলার পর্যটন কেন্দ্র গুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ
মালদা জেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যপূর্ণ একটি জেলা। এখানে অসংখ্য প্রাচীন স্থাপত্য, মসজিদ, মন্দির এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। মালদা জেলার প্রধান কিছু পর্যটন কেন্দ্রের বিবরণ নিচে দেওয়া হলো:
গৌড়
গৌড় একসময় বাংলার রাজধানী ছিল এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এটি ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত এবং প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ এখানকার প্রধান আকর্ষণ। গৌড়ের কিছু উল্লেখযোগ্য স্থান হলো:
* দাখিল দরওয়াজা: এটি গৌড়ের প্রধান প্রবেশদ্বার ছিল। ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই বিশাল ফটকটি লাল ইঁটের তৈরি এবং এতে চমৎকার পোড়ামাটির কাজ দেখা যায়। এটি “সালামি দরওয়াজা” নামেও পরিচিত, কারণ এখান থেকে কামান দাগিয়ে অভিবাদন জানানো হতো।
* ফিরোজ মিনার: এটি গৌড়ের কুতুব মিনার নামেও পরিচিত। সুলতান সাইফুদ্দীন ফিরোজ শাহের সময়কালে নির্মিত এই পাঁচতলা মিনারটি ২৬ মিটার উঁচু এবং এর দেয়ালে সুন্দর পোড়ামাটির নকশা খোদাই করা আছে। এর উপরের দুটি তলা গোলাকার এবং নিচের তিনটি তলা বারো-পার্শ্বযুক্ত।
* বড় সোনা মসজিদ (বারোদুয়ারী মসজিদ): এটি গৌড়ের সবচেয়ে বড় মসজিদ। যদিও এর নাম “বারোদুয়ারী” যার অর্থ বারোটি দরজা, এর আসলে এগারোটি দরজা রয়েছে। এটি আলাউদ্দিন হোসেন শাহ নির্মাণ শুরু করেছিলেন এবং তার পুত্র নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহ ১৫২৬ সালে এটি সম্পন্ন করেন। এটি ইন্দো-আরবি স্থাপত্যশৈলীর এক দারুণ উদাহরণ।
* কদম রসুল মসজিদ: এটি ১৫৩০ সালে সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহ নির্মাণ করেন। এখানে হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) পায়ের ছাপ সম্বলিত একটি পাথরের ফলক রাখা আছে, যা এর প্রধান আকর্ষণ।
* চমকটি মসজিদ / চিকা মসজিদ: এটি সুলতান ইউসুফ শাহ ১৪৭৫ সালে নির্মাণ করেন। এর নাম “চিকা মসজিদ” কারণ একসময় এখানে অনেক বাদুড় (চিকা) আশ্রয় নিত।
আদিনা
আদিনা মালদা শহরের ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং এখানেও বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক আকর্ষণ রয়েছে।
* আদিনা মসজিদ: এটি বাংলার বৃহত্তম মসজিদগুলির মধ্যে অন্যতম এবং ১৩৭৩ সালে সুলতান সিকান্দার শাহ এটি নির্মাণ করেন। এই মসজিদের ভেতরে আরব, বাঙালি, বাইজেন্টাইন এবং পার্সিয়ান স্থাপত্যের মিশ্রণ দেখা যায়। মসজিদের একটি কক্ষে সুলতান সিকান্দার শাহকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
* আদিনা ডিয়ার পার্ক (আদিনা মৃগ উদ্যান): এটি একটি শান্ত বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য একটি সুন্দর স্থান। এখানে চিতল হরিণ এবং নীলগাই দেখা যায়। এটি একটি জনপ্রিয় পিকনিক স্পটও বটে।
* একলাখী সমাধিসৌধ: এটি মালদার একটি সুন্দর ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ, যা তার অনন্য স্থাপত্যশৈলীর জন্য পরিচিত।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান
* মালদা জাদুঘর: মালদা শহরে অবস্থিত এই জাদুঘরে এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন, যেমন – প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা এবং স্থাপত্যের নিদর্শন সংরক্ষিত আছে।
* জগজীবনপুর: মালদা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে হবিপুর ব্লকে অবস্থিত এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি পাল সম্রাট মহেন্দ্রপালদেবের তাম্রফলক শিলালিপির জন্য বিখ্যাত। এখানে নবম শতাব্দীর একটি বৌদ্ধ বিহার, নন্দদীর্ঘিকা-উদ্রাঙ্গ মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষও আবিষ্কৃত হয়েছে।
* জাউহরা কালী মন্দির: মুসলিম স্থাপত্যের প্রাচুর্যের মধ্যে এটি মালদার একটি সুপরিচিত হিন্দু মন্দির। দেবী কালীর প্রতি উৎসর্গীকৃত এই মন্দিরটি একটি উঁচু বেদীর উপর নির্মিত এবং গাছপালায় ঘেরা।
* ফারাক্কা বাঁধ: এটি মালদা জেলার একটি উল্লেখযোগ্য ইঞ্জিনিয়ারিং কীর্তি, যা গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত।
মালদা জেলা ভ্রমণ ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী এবং যারা প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য জানতে চান, তাদের জন্য একটি দারুণ গন্তব্য। শীতকাল (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি) মালদা ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়, কারণ এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম থাকে।