নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক

নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান (Neora Valley National Park) পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলায় অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে এটি সরকারিভাবে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষিত হয়। ৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই উদ্যানটি উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অরণ্যভূমি হিসেবে পরিচিত।

অবস্থান ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য:

 * অবস্থান: এটি পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলায় অবস্থিত। এর সীমানা সিকিম এবং ভুটানের সাথে সংযুক্ত।

 * উচ্চতা: এই উদ্যানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮৩ মিটার (৬০০ ফুট) থেকে শুরু করে ৩২০০ মিটার (১০,৪৯৯ ফুট) পর্যন্ত উচ্চতায় অবস্থিত। এর সর্বোচ্চ বিন্দু হল রাচেলা ডান্ডা (Rachela Danda), যা প্রায় ১০,৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।

 * ভূ-প্রকৃতি: নেওড়া ভ্যালির বেশিরভাগ এলাকা এখনও দুর্গম এবং মানুষের জন্য পুরোপুরি অগম্য। এখানে রুক্ষ পাহাড়ি এলাকা, ঘন জঙ্গল এবং ঝরনা দেখা যায়। নেওড়া নদী, যা কালিম্পং শহরের প্রধান জল উৎস, এই উদ্যানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়।

 * জলবায়ু: এখানে গ্রীষ্মমন্ডলীয়, উপ-ক্রান্তীয়, নাতিশীতোষ্ণ এবং আলপাইন – বিভিন্ন ধরণের জলবায়ু এবং উদ্ভিদ ব্যবস্থা বিদ্যমান।

জীববৈচিত্র্য:

নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান তার অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের জন্য সুপরিচিত। এটি একটি “জীববৈচিত্র্য হটস্পট” হিসেবে গণ্য হয় এবং এখানে বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর দেখা মেলে।

 * প্রাণীজগত:

   * স্তন্যপায়ী প্রাণী: রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, বনবিড়াল, কালো ভালুক, লাল পান্ডা (Red Panda), হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার, দেশি বনরুই, সম্বর হরিণ, গোরাল, বন ছাগল, ক্লাউডেড লেপার্ড, মার্বেড ক্যাট, গোল্ডেন ক্যাট, লেপার্ড ক্যাট, জঙ্গল ক্যাট ইত্যাদি।

   * পাখি: এই উদ্যানটি পাখি পর্যবেক্ষকদের জন্য স্বর্গ। এখানে ২৬০ টিরও বেশি প্রজাতির পাখি দেখা যায়, যার মধ্যে রয়েছে হিল পারট্রিজ, স্যাটিয়ার ট্রাগোপান, কালিজ ফিজেন্ট, রেড-হেডেড ট্রোগন এবং ওয়ার্ল্ডস ট্রোগন। সম্প্রতি এখানে ইয়েলো-রাম্পড হানিকাইড (Yellow-Rumped Honey Guide) দেখা গেছে।

   * এছাড়াও, বিভিন্ন প্রজাতির মাকড়সা, ব্যাঙ, পিঁপড়ে, প্রজাপতি এবং কীটপতঙ্গ এখানে পাওয়া যায়।

 * উদ্ভিদজগত: এখানে ঘন মিশ্র প্রজাতির বন দেখা যায়, যেমন – রডোডেনড্রন, বাঁশ, ওক, ফার্ন, সাল ইত্যাদি। এই উপত্যকা বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিডের জন্যও বিখ্যাত। এখানে গন্ধযুক্ত এক ধরনের লাল রঙের বন্য জবা ফুলও পাওয়া যায়।

গুরুত্ব ও সংরক্ষণ:

নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান উত্তরবঙ্গের অ্যামাজন হিসেবে পরিচিত। এই উদ্যানটি কান্চনজঙ্ঘা ল্যান্ডস্কেপের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুর্গমতা সত্ত্বেও, বন বিভাগ এখানে ট্র্যাপ ক্যামেরার মাধ্যমে বন্যপ্রাণীদের উপর নজর রাখে এবং তাদের সংরক্ষণের জন্য কাজ করে। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার এবং লাল পান্ডাদের মতো বিরল প্রজাতির প্রাণীদের আবাসস্থল হওয়ায় এই উদ্যানের গুরুত্ব আরও বেড়েছে।

পর্যটন ও প্রবেশাধিকার:

 * প্রবেশাধিকার: উদ্যানের কোর এলাকায় সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত এবং অনেকটাই দুর্গম। তবে এর কিছু অংশে ট্রেকিংয়ের সুযোগ রয়েছে। উদ্যানের প্রবেশাধিকারের জন্য লাভা বা সামসিং থেকে প্রবেশ অনুমতি নিতে হয়।

 * ভ্রমণের সেরা সময়: অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত নেওড়া ভ্যালি ভ্রমণের জন্য সেরা সময়। এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম থাকে এবং কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ অন্যান্য হিমালয়ের শৃঙ্গের স্পষ্ট দৃশ্য দেখা যায়। বসন্তকালে 

(মার্চ-এপ্রিল) অর্কিড এবং অন্যান্য ফুল ফোটে, যা দৃশ্যটি আরও মন মুগ্ধকর করে তোলে। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত উদ্যানটি খোলা থাকে, তবে রবিবার দুপুর ১২টায় বন্ধ হয়ে যায়।

নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যান প্রকৃতির এক অসাধারণ উপহার, যা তার অবারিত সৌন্দর্য এবং অনন্য জীববৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস:

 * নেওড়া ভ্যালি একটি দুর্গম এলাকা, তাই ভ্রমণের আগে ভালো করে পরিকল্পনা করে নিন।

 * এখানে নেটওয়ার্কের সমস্যা থাকতে পারে, তাই আগে থেকে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ সেরে নিন।

 * শীতকালে তাপমাত্রা অনেক কমে যায়, তাই পর্যাপ্ত গরম পোশাক সঙ্গে নিন।

 * বর্ষাকালে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) রাস্তা পিচ্ছিল এবং দুর্গম হয়ে ওঠে, তাই এই সময়ে ভ্রমণ এড়িয়ে চলা ভালো।

 * উদ্যানের ভিতরে প্রবেশের জন্য বন বিভাগের নিয়মাবলী মেনে চলুন।

কিভাবে এখানে আসবেন

 * নিকটতম বিমানবন্দর হলো বাগডোগরা বিমানবন্দর (Bagdogra Airport), যা শিলিগুড়ির কাছে অবস্থিত।

 * বাগডোগরা থেকে নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানের প্রবেশপথ লাভা বা সামসিং-এ পৌঁছানোর জন্য ট্যাক্সি বা ভাড়া করা গাড়ি নিতে পারেন। বাগডোগরা থেকে লাভা প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

রেলপথে:

 * নিকটতম প্রধান রেলওয়ে স্টেশন হলো নিউ জলপাইগুড়ি (New Jalpaiguri – NJP)। এটি শিলিগুড়ির কাছে অবস্থিত।

 * নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে লাভা বা সামসিং-এর জন্য ট্যাক্সি বা বাস পাওয়া যায়।

সড়কপথে:

 * শিলিগুড়ি বা কালিম্পং থেকে লাভা বা সামসিং-এর জন্য বাস বা ট্যাক্সি পাওয়া যায়।

 * লাভা থেকে নেওড়া ভ্যালি জাতীয় উদ্যানের প্রবেশপথের দূরত্ব খুব বেশি নয়। কোলাখাম গ্রামটিও উদ্যানের কাছাকাছি অবস্থিত এবং সেখানেও থাকার ব্যবস্থা আছে।

 * উদ্যানের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য লাভা বা সামসিং থেকে বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়।

Google Maps

Scroll to Top