শান্তিনিকেতন
শান্তিনিকেতন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার এক সাংস্কৃতিক পীঠস্থান, যা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এটি কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, শিল্প, সাহিত্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকার এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
শান্তিনিকেতন: কী দেখবেন, কী করবেন?
শান্তিনিকেতনের প্রতিটি কোণায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এখানে প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলো হলো:
* রবীন্দ্রভবন মিউজিয়াম (Rabindra Bhaban Museum): এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও কর্মকে উৎসর্গীকৃত একটি জাদুঘর। এখানে কবির ব্যবহৃত ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, নোবেল পুরস্কারের রেপ্লিকা, অগণিত পাণ্ডুলিপি, চিত্রকর্ম এবং চিঠিপত্র সংরক্ষিত আছে। শান্তিনিকেতন ভ্রমণ শুরু করার জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান।

* বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (Visva-Bharati University): রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটি প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে এক মুক্ত শিক্ষাঙ্গন। এখানে ছাতিনতলা, যেখানে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের পিতা) ধ্যান করতেন এবং বিশ্বভারতীর সপ্তপর্ণী গাছের ডাল দিয়ে স্নাতকদের দীক্ষা দেওয়া হয়, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রয়েছে চীনা ভবন, সঙ্গীত ভবন, পাঠ ভবন, নিপ্পন ভবন, ইত্যাদি।
* উত্তরায়ণ কমপ্লেক্স (Uttarayan Complex): এটি বিশ্বভারতীর একটি অংশ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবাসস্থল ছিল। ১৯১৯ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে বাস করতেন। এই কমপ্লেক্সে উদয়না, কোণার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ এবং উদয়ী নামের পাঁচটি সুন্দর স্থাপত্যের বাড়ি রয়েছে। প্রতিটি বাড়ির নিজস্ব ইতিহাস ও সৌন্দর্য আছে। এখানে কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং তাঁর আঁকা কিছু চিত্রকর্মও দেখতে পাওয়া যায়।


* কলাভবন (Kala Bhavana): এটি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, যা ১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ভিজ্যুয়াল আর্টস নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানে বিখ্যাত শিল্পীদের কাজ এবং শিক্ষার্থীদের সৃষ্টি দেখতে পাবেন। কলাভবনের স্থাপত্যশৈলী এবং দেয়ালচিত্রগুলোও নজরকাড়া। এখানে একটি ছোট্ট জাদুঘরও আছে।
* উপাসনা গৃহ (Upasana Griha): এটি কাঁচের তৈরি একটি সুন্দর প্রার্থনা কক্ষ, যা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে নির্মাণ করেন। এটিকে “কাঁচ মন্দির” নামেও ডাকা হয় এবং এর সূক্ষ্ম কাঁচের কাজগুলো সন্ধ্যায় আলোর ঝলকানিতে বিশেষভাবে সুন্দর লাগে।

* আমার কুটির (Amar Kutir): এটি একটি ঐতিহাসিক সমবায় কেন্দ্র, যা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বর্তমানে এখানে স্থানীয় কারিগরদের তৈরি হস্তশিল্প, চামড়ার ব্যাগ, পার্স, হাতে বোনা কাপড়, বাটিকের কাজ এবং অন্যান্য স্মারক সামগ্রী পাওয়া যায়। এটি স্থানীয় শিল্পীদের সমর্থন করার একটি চমৎকার জায়গা।
* খোয়াই সোনাঝুরি জঙ্গল এবং শনিবারের হাট (Khoai Sonajhuri Forest & Saturday Haat): শান্তিনিকেতনের এক অনবদ্য আকর্ষণ হলো খোয়াই অঞ্চলের লাল মাটির ভূমি এবং সোনাঝুরি জঙ্গল। প্রতি শনিবার বিকেলে এখানে একটি খোলা আকাশের নিচে হস্তশিল্পের হাট বসে। স্থানীয় আদিবাসী ও গ্রামীণ শিল্পীরা তাদের তৈরি গয়না, পোশাক, বাদ্যযন্ত্র, এবং অন্যান্য লোকশিল্পের জিনিসপত্র বিক্রি করেন। এখানে বাউল গান বা লোকনৃত্য পরিবেশন হতে দেখা যায়, যা এক ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা দেয়।
শান্তিনিকেতন ভ্রমণের সেরা সময়
শান্তিনিকেতন ভ্রমণের জন্য নভেম্বর থেকে মার্চ মাস সবচেয়ে উপযোগী। এই সময় আবহাওয়া মনোরম থাকে, দিনগুলো রৌদ্রোজ্জ্বল ও আরামদায়ক। শীতকালে এখানে বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠান হয়, যেমন পৌষ মেলা (ডিসেম্বরের শেষ দিকে) এবং বসন্ত উৎসব বা দোল (মার্চ মাসে)। এই সময়ে গেলে শান্তিনিকেতনের আসল প্রাণশক্তি উপভোগ করা যায়।
বর্ষাকাল (জুলাই-সেপ্টেম্বর) শান্তিনিকেতনকে এক ভিন্ন রূপে সাজিয়ে তোলে। চারপাশ সবুজে ভরে ওঠে এবং কোপাই নদীর জল টলমল করে। এই সময় ভিড় কম থাকে, তাই শান্ত ও নির্জন পরিবেশে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে চাইলে বর্ষাকালও ভালো বিকল্প হতে পারে। তবে গ্রীষ্মকালে (এপ্রিল-জুন) তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে, তাই এই সময় ভ্রমণ এড়িয়ে চলা ভালো।
থাকার ব্যবস্থা
শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন ধরনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, বাজেট-ফ্রেন্ডলি গেস্ট হাউস থেকে শুরু করে আরামদায়ক রিসর্ট পর্যন্ত সবই পাওয়া যায়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গেস্ট হাউসও আছে। উৎসবের সময় ভিড় বেশি থাকে, তাই আগে থেকে বুকিং করে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
* শান্তিনিকেতন একটি শান্ত জায়গা। এখানে পায়ে হেঁটে অনেক কিছু ঘুরে দেখা যায়।
* অনেক ছোট দোকানে ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবস্থা নাও থাকতে পারে, তাই সঙ্গে কিছু নগদ টাকা রাখা ভালো।
* বিশ্বভারতীর কিছু স্থানে প্রবেশের জন্য অনুমতি বা টিকিট লাগতে পারে, বিশেষ করে রবীন্দ্রভবন মিউজিয়ামে।
* স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন।
* সন্ধ্যায় খোয়াই বাউল গানের আসর বসে, সেই অভিজ্ঞতা নেওয়া যায়।
শান্তিনিকেতন ভ্রমণ আপনাকে কেবল নতুন কিছু শেখাবে না, আপনার মনকে শান্ত করবে এবং এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার স্বাদ দেবে।

Google Maps
কিভাবে এখানে আসবেন
* বিমান: শান্তিনিকেতনের নিকটতম বিমানবন্দর হলো কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (CCU)। বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগে।
* রেল: শান্তিনিকেতনের নিজস্ব কোনো রেলওয়ে স্টেশন নেই। নিকটতম স্টেশন হলো বোলপুর শান্তিনিকেতন (BPL)। কলকাতা থেকে জনশতাব্দী এক্সপ্রেস, শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস, বা কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের মতো ট্রেনগুলো বোলপুরের জন্য পাওয়া যায়। দিল্লি বা মুম্বাই থেকে সরাসরি ট্রেন পেতে হলে আসানসোল বা হাওড়া এসে সেখান থেকে বোলপুরের ট্রেন ধরতে হবে। বোলপুর স্টেশন থেকে শান্তিনিকেতন মাত্র ২-৩ কিলোমিটার দূরে, রিকশা বা অটোতে সহজেই পৌঁছানো যায়।
* সড়ক: কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনের দূরত্ব প্রায় ১৬০-১৮০ কিলোমিটার। ন্যাশনাল হাইওয়ে ১৯ (NH19) ধরে গাড়িতে বা বাসে প্রায় ৩-৪ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়। সরকারি এবং বেসরকারি বাস পরিষেবা উভয়ই উপলব্ধ।